একটি ফোনকল। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে একজন বলছেন, ‘আমার আব্বা করোনার সময় মারা গেছেন। আব্বা মৃত্যুর আগে শেষ যে খাবারটি খেয়েছিলেন, সেটি ছিল ‘এন’স কিচেন’‑এর তৈরি। সামনের মাসে আব্বার মৃত্যুবার্ষিকী। আমাদের পরিবারের একান্ত চাওয়া, আব্বার মৃত্যুবার্ষিকীর খাবার যেন ‘এন’স কিচেন’ তৈরি করে।’ …একজন রন্ধনশিল্পীর কাছে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু হতে পারে না।
খাদ্যবিষয়ক উদ্যোক্তা ফাতেমা আবেদীন (নাজলা)। তিনি এন’স কিচেন‑এর কর্ণধার ও একজন রন্ধনশিল্পী। এন’স কিচেন‑এর নাম নাজলা নামের প্রথম অক্ষর ‘এন’ দিয়ে শুরু। কিন্তু বর্তমানে তাঁর স্বামী আর মেয়ের নামও ‘এন’ দিয়ে শুরু। নাজলা, নয়ন আর নিহিরা।
২০২০ সালে এন’স কিচেন’‑এর যাত্রা শুরু। এরপর থেমে নেই পথচলা। চার বছরের মধ্যে ধানমন্ডির নিরিবিলি পরিবেশে তৈরি করেছেন ‘ইন ডাইন রেস্তোরাঁ’। এখানে যারা খেতে আসেন, তারা ইন ডাইন রেস্তোরাঁয় বাড়ির পরিবেশে আরাম আয়েশে তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারেন।
এবারের জাতীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) মেলায় এন’স কিচেন অর্জন করেছে পুরস্কার। কিন্তু এই পুরস্কারে চেয়ে মানুষের আস্থা, ভালোবাসা আর বিশ্বাসকে অনেক বড় পাওয়া মনে করেন নাজলা। তিনি বলেন, ‘করোনাকালে যারা ভেন্টিলেশনে ছিলেন, যারা নল দিয়ে খাবার খেতেন, তাঁদের জন্য আমরা চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের সঙ্গে কথা বলে নিয়ম মেনে রোগীর উপযোগী খাবার তৈরি করতাম। এতে সেই মানুষগুলোর সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সময় আমাদের ৩০ থেকে ৪০ জন গ্রাহক ছিলেন, যাদের অনেকেই মৃত্যুর আগে শেষ খাবার খেয়েছেন এন’স কিচেন থেকে। মানুষের মনে আস্থার জায়গা তৈরি করতে পেরেছি, এটা আমাদের জন্য অনেক বড় অর্জন।’
ফাতেমা আবেদীন তাঁর উদ্যোক্তা জীবনে দেখেছেন করোনাকাল। আবার দেখেছেন ২০২৪ সালের দেশের চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। এই দুই সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে কোনটি উদ্যোক্তাদের জীবনে সংকট তৈরি করেছে, তা জানতে চাইলে জুলাই‑আগস্টের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি অনেক বেশি সংকটের বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ‘২০২০ সালে খাবারের ব্যবসা চালু করার পরপরই করোনা চলে আসে। এ সময় আমরা বিকাশের মাধ্যমে লেনদেন শুরু করি। কারণ টাকার মাধ্যমে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার একটা বিষয় ছিল। করোনাকালে আর্থিক লেনদেনের ব্যবস্থা ছিল, করোনাকালে আমাদের ক্রেতা ছিল। অনলাইনে কিছুটা হলেও ব্যবসায়িক লেনদেন করা গেছে। করোনাকালে অর্থনৈতিক সংকট ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তারা যোগাযোগের অভাবে অনেক বেশি সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে।’
উদ্যোক্তাদের ব্যবসার একমাত্র মাধ্যম অনলাইন। গত তিন মাসে দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে অনেক উদ্যোক্তাই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এ সময়কার স্থবিরতা নিয়ে নাজলা জানান, যারা এফ‑কমার্স বা ই‑কর্মাসে ব্যবসা করেন, তাদের সংখ্যাটা এ দেশে অনেক বেশি। হুট করে একদিন দেখলাম ইন্টারনেট নেই। অনলাইনে কারও সঙ্গে যোগাযোগের উপায় ছিল না। কোনো ধরনের ব্যবসায়িক লেনদেনও করা যায়নি। এতে অনলাইন ব্যবসায়ীদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। এন’স কিচেন ও তাদের কর্মীদের জন্য বাসা ভাড়া দিতে হয়। এ ছাড়া এ সময়ে গ্যাস বিল, বিদুৎ বিল কোনো বিল কিন্তু দেওয়া বন্ধ ছিল না। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমাদের গ্রাহক একেবারেই কম ছিল। ফলে ব্যবসায় ধস নামে।
খাবার মানুষ আনন্দ নিয়ে খেয়ে থাকে। খাবারের ক্ষেত্রে একটা মানসিক প্রশান্তিরও বিষয় থাকে। ভোজনরসিকেরা সেই আনন্দ পেতে যান এন’স কিচেনে। কারও বাড়িতে অতিথি গেলে যেভাবে খাবার পরিবেশন করা হয়, এন’স কিচেনে ঢুকলে তারাও সেই পরিবেশ খুঁজে পান। এখানে বুকিং দিয়ে খেতে আসতে হয়। তবে যে কেউ এসে চা‑কফি চাইলে খেতে পারেন। আবার টুকটাক নাস্তাও করতে পারেন। কিন্তু একটু আরাম আয়েশে খেতে চাইলে, আসার এক ঘন্টা আগে পেজের ইনবক্সে বা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ফোন নম্বরে বুকিং দিয়ে আসতে হয়।
নারী উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন থেমে নেইনারী উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন থেমে নেই
বুকিং দিয়ে এলে এখানকার কর্মীরা একটু আরামে খাবার রান্না ও পরিবেশনের সময় পান। এর কারণ হিসেবে এন’স কিচেন‑এর কর্ণধার নাজলা বলেন, ‘আমরা চাই না বাড়তি খাবার নষ্ট হোক বা ফেলে দেওয়া হোক। আমরা একগাদা খাবার রান্না করে রেখে দিতেই পারি। ২০ রকমের খাবার রান্না করে রেখে দিলাম। আর গ্রাহকেরা এসে যে যার পছন্দ মতন খেলেন। এটা হতেই পারে। কিন্তু এতে অনেক খাবার নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার নষ্ট না হয়ে খাবারটা যদি জমা থাকে, তাহলে খাবারটা পরদিন দিতে হবে। আমরা এভাবে পুরোনো খাবার দিতে চাই না।’
‘
ফাতেমা আবেদীন নাজলা একসময় শিক্ষকতা করেছেন। এরপর দীর্ঘদিন সাংবাদিক পেশায় যুক্ত ছিলেন। এর পর নিজের ভালোলাগার জায়গা থেকে থেকেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন বোনেন। হন খাদ্যবিষয়ক উদ্যোক্তা। রান্নার প্রতি আগ্রহের কারণ হিসেবে দাদি‑নানি‑মায়ের কথাই বলেন। তাঁরা সকলেই রান্না করতে অনেক বেশি পছন্দ করতেন। একবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর নাজলার মা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর একটা বড় অস্ত্রোপচার হয়। ডাক্তার স্যুপ খাওয়াতে বলেন। মায়ের অসুস্থতার সময় নাজলা স্যুপ বানান। কিন্তু সেই স্যুপ খুব একটা ভালো হয়নি। এতে নাজলার মধ্যে এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করে। এরপর জেদ থেকেই রান্না শুরু করেন।
এখন ৩০ কেজি পোলাও একা হাতে রান্না করেন নাজলা। একদিনে ১ হাজার ২৫০ জনের রোস্টও রান্না করেন তিনি। চাকরি না করে কেন উদ্যোক্তা হলেন? তাও আবার খাদ্যবিষয়ক উদ্যোক্তা। এ প্রসঙ্গে নাজলা জানান, ‘আমি রান্না করতে পছন্দ করি। পারিবারিক উৎসাহের জায়গায় থেকে রান্নার কাজ শুরু করি। মায়ের অসুস্থতার বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে। একটা সময় বেশ কয়েক বছর দেশের বাইরে ছিলাম বেশ। সেখানেও রান্না করি। রান্না আপনি তখনই ভালো করতে পারবেন, যখন আপনি খেতে জানবেন। আমি সেখানেও ঘুরে ঘুরে খাবার খেতাম আর রান্না করতাম।’
নাজলা বলেন, ‘এরপর দেশে ফিরে সাংবাদিকতা শুরু করি। ২০১৪ সালে হাতের কাজের শাড়ির ব্যবসা শুরু করি। ২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গু মহামারি আকার নেয়। এ সময় আমার আশপাশের অনেকেই মারা যান। মনে মনে ভাবি, শাড়ি বা পোশাক মনের আনন্দ বা উৎসব ছাড়া পরা যায় না। তবে, প্রয়োজন আলাদা জিনিস। মনে আনন্দ না থাকলে পোশাক কেনা হয় না। তাই শাড়ির ব্যবসা থেকে সরে আসি। এরপর করোনাকাল এল। চালু হলো হোম অফিস। হোম অফিস করতে করতে একটা সময় মনে হলো, ফুলটাইম রান্নাবান্নায় সময় দেব। ফলে ক্যারিয়ারের পিক টাইমে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে রান্নাবান্নার দিকে মনোযোগ দিই।’
নাজলার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল, একটা ভাতের হোটেল দেওয়ার। যেখানে মানুষজন নিজের বাড়ির মতো আরাম‑আয়েশে তৃপ্তি নিয়ে খাবেন। এ ক্ষেত্রে বিভূতিভূষণের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ আর শ্রীলংকার লেখক রমেশ গুনেসেকেরা গল্প ‘খোলস’ তাঁর অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
তবে খাদ্যবিষয়ক উদ্যোক্তা হবেন–এই মনোবল তাঁর একদিনে তৈরি হয়নি। এর জন্য দীর্ঘদিন সময় লেগেছে। ২০২০ সালে অনলাইনে যাত্রা করে ‘ইন ডাইন’ রেস্তোরাঁয় আসতে চার বছর সময় লেগেছে। এখান থেকে এ পর্যন্ত যারা খাবার নিয়েছেন বা খেয়েছেন, তাঁরা কেউ কোনোদিন বলেননি, ‘এখানকার খাবার সতেজ বা ভালো না।’ আবার এখানকার খাবার খাওয়ার পর কারও গলা জ্বলা বা অ্যাসিডিটির সমস্যা হয়নি। কারণ, তেল ও হাইজিনের বিষয়ে এখানে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না।
এন’স কিচেন‑এ বর্তমানে কর্মী আছেন ১৩ জন। এর মধ্যে তিনজন বাইরে থাকেন। বাকি ৮ জনের জন্যে যে বাসা ভাড়া নেওয়া আছে, তাঁরা সেখানে থাকেন। কর্মীদের খাবারের ব্যবস্থাও এখান থেকে করা হয়। দুজন ম্যানেজার আছেন। এখানে পেজ ম্যানেজার আছেন তিনজন, যারা অনলাইনের বিষয়টা দেখেন। সকাল ৮টা থেকে কার্যক্রম শুরু হয়। তবে ডাইনিং এ খেতে আসা যায় দুপুর একটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। এখানে বইয়ের কর্ণার আছে। কেউ খেতে এসে যদি বই পড়তে চান, তাহলে নিরিবিলি পরিবেশে বই পড়তে পারেন। এখানে মোবাইল দেখার চাইতে বই পড়াকে সবসময় উৎসাহিত করা হয়।
নাজলা দীর্ঘদিন ধরে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুড়িতে জমা হয়েছে অনেক কিছু। এখন তো অনেক নারীই উদ্যোক্তা হচ্ছেন। নারী উদ্যোক্তাদের স্বপ্নের জায়গাটা কী হওয়া উচিত? এমন প্রশ্নে নাজলা জানান, চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেশের নারী উদ্যোক্তাদের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। মনোবল নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ব্যবসা করতে হলে অনেকগুলো বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। যেমন লাভ‑ক্ষতি বুঝতে হবে। ব্যবসার পদ্ধতি জানতে হবে। উদ্যোগ চলাকালে অনেক ধরনের সমস্যা বা বাধা আসতে পারে। সেসব সমস্যা মোকাবিলা করার মনোবল থাকতে হবে। পাশাপাশি আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। ছোট চিন্তা করা যাবে না। ব্যবসার ক্ষেত্রে সিগনেচার পণ্য দাঁড় করাতে হবে। নারী উদ্যোক্তা হয়ে ছয়টা শাড়ি বিক্রি করে অনেক টাকা লাভ করলাম। এভাবে ভাবা যাবে না। নিজের সিগনেচার পণ্য হিসেবে ৬০টি শাড়ি তৈরির উদ্যোগ হাতে নিতে হবে।
দেশে সফল, এবার বিদেশেও ব্যবসা বাড়াতে চান ৬ নারী উদ্যোক্তাদেশে সফল, এবার বিদেশেও ব্যবসা বাড়াতে চান ৬ নারী উদ্যোক্তা
বর্তমানে এন’স কিচেন দেশি ভর্তা, ভাজি থেকে শুরু করে রোস্ট, পোলাও, খিঁচুড়ি বা কাচ্চি বিরিয়ানিও পাওয়া যায়। নাজলা প্রতিদিনের খাবারে বৈচিত্র্য আনেন। সেই খাবারে থাকে দেশীয় ও আঞ্চলিক খাবার। বর্তমানে এন’স কিচেন থেকে একই সময়ে ১৫০০ মানুষের খাবার দেওয়া যায়। সামনের বছর মাইডাস সেন্টারে এন’স কিচেন‑এর উদ্যোগে একটি মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। মেলাতে বিভিন্ন উদ্যোক্তার পণ্য যেমন থাকবে, তেমনি শিশুদের জন্য একটা কর্ণার থাকবে।
ভবিষ্যতে এন’স কিচেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ‘ইন ডাইন’ রেস্তোরাঁ হবে–এমন স্বপ্ন দেখেন নাজলা। তিনি বলেন, ‘এখান থেকে প্রতিদিন ঢাকা শহরের ১০ হাজার মানুষকে খাওয়াতে চাই। হোম ডেলিভারিকে সহজলভ্য করতে চাই। যাতে মানুষ বাসায় বসে বসে এন’স কিচেনের গরম গরম খাবার খেতে পারেন।’